বর্তমান সময়ের গুণী অভিনেতা, নাট্য নির্দেশক, নাট্যকার এবং দক্ষ একজন অনুবাদক আশীষ খন্দকার। যদিও বেশ কিছুদিন যাবৎ পত্রপত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন দুইজন চোর। ঠিক চোর নয়, খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন দুইজন অভিনেতাকে, যাদের দিয়ে তার প্রিয় দুটি চরিত্রের রোলপ্লে করাতে পারেন মঞ্চে। কিন্তু কি সেই গল্প, আর কি ঘটনাই বা তাঁর নেপথ্যে?
জানা গেছে, জুয়েল কবির রচিত ‘চ্যাপলিন’স কফিন’ নাটকটিতে রোমান ওয়ারদাস এবং গ্যানচো গ্যানেভ নামের দুই বুলগেরিয়ান চোরের চরিত্রে রূপদানের জন্যেই নাকি অভিনেতার এই চোর খোঁজার বিজ্ঞাপন। আশীষ খন্দকারের মতে, এর চোরদ্বয় যে কমেডি করবে সেটা কোনো ভাঁড়ামো নয়, এটা অনেকটা হবে কমেডিয়া ডেল আর্তের আদিরূপের আদলে। চোরদ্বয়কে দেখলে মনে হবে রাস্তায় কুঁড়িয়ে পাওয়া পঁচা পাউরুটির ভোক্তা, কিন্তু তারা নিজেরা হাসবে না, অভিনয়ে সিরিয়াস থেকে হাসাবে দর্শকদের, কাঁদাবে এবং ভাবাবেও দর্শককে।
এবার জানা যাক, নাট্য ঘটনা। নাটকের নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে এ নাটকের প্রেক্ষাপটে আছে, চার্লি চ্যাপলিন এবং তার কফিন। নাট্যকার জুয়েল কবিরের মাধ্যমে জানা যায়, ‘কিংবদন্তি অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার চার্লি চ্যাপলিন ১৯৭৭ সালের বড়দিনে তার সুইজারল্যান্ডের বাড়িতে মারা যান। জেনেভা লেকের তীরে একটি গ্রামে তার বাড়ির ঠিক পাশেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁর কফিনটি ৬৫ দিনের মাথায় চুরি হয়ে যায়। ঘটনাটি ১৯৭৮ সালের ১লা মার্চের। সুইজারল্যান্ডে বসবাসরত চার্লি চ্যাপলিনের বিধবা স্ত্রী উনা ও’নীলের কাছে স্থানীয় পুলিশের একটি কল আসে। বিব্রত পুলিশ কর্মকর্তা তাকে জানায়, “আপনার স্বামীর কবর খুঁড়ে কে যেন তার লাশ চুরি করে নিয়ে গেছে।”
এমন বিস্ময়কর চুরির আগাগোড়া বুঝে ওঠার আগেই রোমান ওয়ারদাস এবং গ্যানচো গানেভ নামক কফিন চোরদ্বয় চ্যাপলিনের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে। তারা জানায়, তাদেরকে ছয় লাখ ডলার দিলেই তারা চ্যাপলিনের লাশ ফিরিয়ে দিবে।দুই চোর চ্যাপলিনের বিধবা স্ত্রীকে চিঠি দিয়ে এসব জানায়, এবং সঙ্গে পাঠায় চ্যাপলিনের কফিনের এই ছবিটি।
সেইসাথে চোরেরা মুক্তিপনের টাকা না পেলে চ্যাপলিনের ছোট দুই সন্তানকে মেরে ফেলারও হুমকি দেয়। এই পরিস্থিতিতে পুলিশের সাহায্য নেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না উনা ওনীলের। চোরদের ধরতে পুলিশ ব্যাপক আয়োজন করে। চুরির ঘটনার পর পাঁচ সপ্তাহ পর্যন্ত চ্যাপলিনের বাড়ির টেলিফোন ট্যাপ করে রাখে তারা। আর গোটা শহরজুড়ে প্রায় ২০০ ফোন বুথের সব টেলিফোনের উপর নজর রাখা শুরু করেন গোয়েন্দারা। পরিকল্পনা কাজে দেয়। এরপরই যখন লাশের ব্যাপারে চ্যাপলিনের বাসায় ফোন আসে, সাথে সাথেই চোরদের আটক করে ফেলা হয়। চোর দুজন ছিল বুলগারিয়ান। সুইজারল্যান্ডে অভিবাসী হিসাবে থাকার সময়টায় আর্থিক সঙ্কট কাটাতে তারা এই অভিনব ফন্দি আঁটে।
ওয়ারদাস ও গ্যানেভ নামের এই দুই মেকানিকের মধ্যে ওয়ারদাসই সব পরিকল্পনা করে। কফিন চুরির অপরাধের মাস্টারমাইন্ড হিসাবে তাকে সাড়ে চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। গানেভকে দেড় বছরের কারাদণ্ড।’
এমন একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার সাথে নাট্যকার জুয়েল কবির নাট্যঘটনার পরতে পরতে যুক্ত করেছেন চ্যাপলিনের চলচ্চিত্র দর্শন। কিংবদন্তির পোড়খাওয়া জীবনের সাথে এ এক অসাধারণ ব্লেন্ডিং। সংলাপের চমৎকারিত্ব এবং ঘটনার আকষ্মিকতার মাঝে নাট্যকার অবলীলায় বলে গেছেন চার্লির মত একজন মহান শিল্পীর পুরো জীবন। চমৎকার নাটকীয় আবহ তৈরি করে নাটকটিতে এমন টান টান আবহের সৃষ্টি করা হয়েছে; যা দর্শককে উদ্বিগ্ন করে রাখবে নিঃসন্দেহে। নাট্যআবহ তৈরি এবং ক্লাইমেক্স সৃষ্টিতে নাট্যকার যে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছে তা এক কথায় অসাধারণ এবং ঈর্ষণীয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে আপাতত চরিত্র সংখ্যা দুটো মনে হলেও একেকটি চরিত্র একাধিক চরিত্ররূপে উপস্থাপিত হবে। সঙ্গত কারণেই নির্দেশক আশীষ খন্দকার মেধাদীপ্ত এই নাটকটিতে স্কিলড এবং কমিটেড নাট্য অভিনেতার সন্নিবেশ ঘটাতে চলেছেন।
আশীষ খন্দকারের ল্যাবরেটরিতে এখন নিয়মিতই এ নাটকের মহড়া চলছে। নির্দেশক দু ধরণের উপস্থাপনায় নাটকটিকে মঞ্চে আনতে যাচ্ছেন; এক- পরিবেশ থিয়েটারের আদলে, দুই-প্রসেনিয়াম থিয়েটারে উপস্থাপনের জন্যে। ধারণা করা হচ্ছে আগামী এপ্রিল মাসেই হয়তো এ নাটকটির স্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন ঢাকার দর্শক।