শিল্পের শুভ্র পথে অশিল্পের জন্ম ঠেকিয়ে দিতে
গল্পকথনের পরশে দর্শকের মন ভরিয়ে দিতে
দেশে দেশে, যুগে যুগে নাট্যকারের জন্ম হয়,
উদাত্ত কন্ঠে শোনায় তারা নতুনের গান,
জরাজীর্ণতার মাঝে বুনে দেয় স্বপ্নের বীজ
দৃশ্যকল্পে এঁকে দেয় মুক্তির স্লোগান।।
অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ঢাকার একটি অভিজাত হোটেলে গতকাল সন্ধ্যায় (১৪ মে) অভিষিক্ত হলেন নাট্যকার সংঘের নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি (২০২৪-২৬)। নাট্যকার সংঘের কার্যনির্বাহী কমিটির ১৯ জন নাট্যকারকে এদিন সন্ধ্যায় অভিষিক্ত করলেন পিতৃ সমতুল্য, সর্বজন গুরু, বটবৃক্ষ নাট্যজন মামুনুর রশীদ ও নাট্যকারবৃন্দ। এ-সময় মামুনুর রশীদের সঙ্গে মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন নাট্যকার সংঘের উপদেষ্টামণ্ডলির সদস্য- আবুলহায়াত, মাসুমরেজা, বৃন্দাবন দাস ও শিহাব শাহীন। উপদেষ্টামণ্ডলির অন্যতম সদস্য কথা সাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজরুল ইসলাম দেশের বাইরে থাকায় এবং হারুন রশীদ ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত থাকায় অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। উপদেষ্টা মণ্ডলিকে সর্বজন সম্মুখে পরিচয় করিয়ে দেন নাট্যকার সংঘের সভাপতি এজাজ মুননা।
টেলিভিশন নাট্যকার সংঘের কার্যনির্বাহী কমিটি (২০২৪-২৬)-এর সভাসদরা হলেন-
সভাপতি- এজাজ মুননা
সহ-সভাপতি- পান্থ শাহরিয়ার, শফিকুর রহমান শান্তনু, মোস্তফা মনন
সাধারণ সম্পাদক- জাকির হোসেন উজ্জ্বল
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক- আজম খান, টুকু মজনিউল, সাজিন আহমেদ বাবু
সাংগঠনিক সম্পাদক- রাজীব মণি দাস
অর্থ সম্পাদক- মনসুর রহমান চঞ্চল
প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক- কামরুল আহসান
তথ্যপ্রযুক্তি ও অনুষ্ঠান সম্পাদক- এলিনা শাম্মি
আইন ও কল্যাণ সম্পাদক- মানস পাল
দপ্তর সম্পাদক- আফরিন জেসিকা
গবেষণা ও প্রশিক্ষণ সম্পাদক- জুয়েল কবির।
কার্যনির্বাহী সদস্য- ড. লিপি মনোয়ার, আহমেদ শাহাবুদ্দীন, মেজবাহ উদ্দীন সুমন, লিটু সাখাওয়াত
অভিষেক অনুষ্ঠানে কার্যনির্বাহী কমিটিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেন: আমরা যেটা পেরেছি নির্যাতন বর্জন করতে পেরেছি। আমি বোধ হয় একটা ভুল করলাম। নির্যাতন বলে ফেলেছি। বলতে চেয়েছিলাম নির্বাচন। কিন্তু, আমি বোধ হয় খুব একটা ভুল করিনি। নির্বাচন তো আমাদের ওপর একটা নির্যাতনের মতোই ব্যাপার। দেশের কোনো নির্বাচনই খুব একটা সুষ্ঠ হয়না। তাই শুরু থেকেই আমরা চেয়েছিলাম নাট্যকার সংঘের নির্বাচন বর্জন করতে। সেটা আমরা পেরেছি। নির্বাচন ছাড়াই আমরা একটা সুন্দর কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করতে পেরেছি। এতে আমাদের সময় ও অর্থ দুইই বেঁচেছে। আমি আশা করব নতুন কমিটি ভালো ভালো কাজ করবে। আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে যে রুচির দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে সেখান থেকে তারা তাদের সৃজনশীল কর্ম দিয়ে আমাদের বের করে আনবে।
উপদেষ্টামণ্ডলির সভ্যরা তাদের বক্তব্যে বলেন-
আবুলহায়াত: উপদেষ্টা হিসেবে কী করতে পারব জানিনা। চেষ্টা থাকবে ভালো কিছু করার। অনেক প্রত্যাশা নিয়ে আমরা অভিষেক অনুষ্ঠান করি বটে, কিন্তু পরে আর খোঁজ-খবর থাকে না। তারপরও আমি আশা করব নতুন কমিটি ভালো কিছু করবে। যে অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আছি, এখান থেকে বের হওয়ার জন্য নতুন কিছু করবে।
মাসুম রেজা: এ রকম অভিজাত একটি এলাকায় যে নাট্যকার সংঘের অভিষেক অনুষ্ঠান হচ্ছে এটাই নাট্যকারদের জন্য একটা সাফল্য। কেন, সেটা আর ভেঙ্গে বলার অপেক্ষা রাখে না। দুবছর পর নতুন কমিটি যেন এরচেয়ে অভিজাত এলাকায় এরকম একটি অভিষেক অনুষ্ঠান করতে পারে।
বৃন্দাবন দাস: উপদেষ্টা হিসেবে বেশ একটা ভাব লাগছে। সিনিয়র হয়ে গেছি মনে হচ্ছে, যে এখন আমিও কাউকে উপদেশ দিতে পারি। মাসুম ভাইযা বললেন, নাট্যকাররা এত ধনী হয়ে গেছে যে এ রকম একটা অভিজাত এলাকায় অভিষেক অনুষ্ঠান হচ্ছে এটাই একটা সাফল্য। আসলে আমাদের নাট্যকাররা এত গরিব এ রকম একটা অনুষ্ঠানের কথা তারা ভাবতেই পারে না। অথচ আমরা গাল ভরা বুলি শুনি- যে-কোনো নাটক-সিনেমায় নাট্যকাররাই প্রধান, আসলেতো নাট্যকাররা মুচির ব্রাহ্মণ। আজকাল ব্রাহ্মণ ছাড়াই পূজো হয়ে যায়, নাট্যকার ছাড়াই নাটক হয়ে যায়।
শিহাব শাহীন: কোনো উপদেষ্টা কমিটিতে এই প্রথম আমি যুক্ত হয়েছি। এই উপদেষ্টা কমিটির মধ্যে আমি সর্বকনিষ্ঠ। আমি যেটা বলতে চাই, সামনের নিউ মিডিয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত হব। আধুনিক একটা সংগঠন হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলব।
নাট্যকার সংঘের কার্যনির্বাহী কমিটিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ডিরেক্টরস গিল্ড- এর সভাপতি অনন্ত হীরা বলেন: আমাদের নাটক-ওটিটি যা-ই বলিনা কেন, আজ ভীষণভাবে ভিউর ভাইরাসে আক্রান্ত। আমাদের সবাইকে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। নাট্যকার সংঘের বর্তমান উপদেষ্টা কমিটি এবং কার্যনির্বাহী কমিটি অত্যন্ত শক্তিশালী, আমি আশা করব এই লড়াইয়ে তারা আমাদের বিকল্প পথ দেখাবে।
অভিনয় শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক রওনক হাসান বলেন: সময় এসেছে নাট্যকার সংঘের চিত্রনাট্যকার সংঘ হওয়ার। কারণ এখন অনেক মাধ্যমে কাজ হচ্ছে । আমি কথা দিচ্ছি, আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করব।
টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টেলিপ্যাব)–এর সভাপতি মনোয়ার পাঠান বলেন: যে- কোনো নাটক-সিনেমা ভালো হওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেন নাট্যকার বা চিত্রনাট্যকার। কাহিনী ভালো না হলে আর কিছুতেই কিছু হয়না। তাই নাট্যকারই আমাদের পথ প্রদর্শক। আমি নতুন কমিটির সাফল্য কামনা করি।
বিশিষ্ট নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা সালাউদ্দিন লাভলুও কার্যনির্বাহী কমিটিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। সালাউদ্দিন লাভলু তার বক্তব্যে বলেন, আমাদের টেলিভিশন জগতে যে অসুস্থ সংস্কৃতি শুরু হয়েছে আমি আশা করব অন্যান্য সংগঠনের সাথে মিলিয়ে তারা এ থেকে আমাদের মুক্তির পথ দেখাবে।
অভিষিক্ত হওয়ার পর নতুন কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি এজাজ মুননা ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করতে গিয়ে নাট্যকারদের উদ্দেশ্যে বলেন: সময়ের সাথে নিজেকে আরও শাণিত করতে আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহন করেছি। গল্পভাবনা এবং এর প্রয়োগ আজ অনন্য উচ্চতায় স্থাপিত হয়েছে। চিত্রনাট্যের বদলও চোখে পড়বার মতোন। তাইতো আমরা আমাদের স্লোগানের প্রতি পূর্ন আস্থা রেখে “উৎকর্ষ সাধনে সচেষ্ট”থাকবার মানসে ১লা জুলাই থেকে তিনমাসব্যাপী স্ক্রীন রাইটিং ওয়ার্কশপ আয়োজন করতে যাচ্ছি। খ্যাতনামা স্ক্রীন রাইটার, টেলিভিশন, ফিল্ম, ওটিটি প্লাটফর্মে যুক্ত থাকা প্রতিভাবান স্টোরিটেলার, ডায়লগ রচয়িতা, প্রডিউসার, প্রডাকশন ডিজাইনার সর্বোপরি প্লে-রাইটার এই ওয়ার্কশপে যুক্ত হয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করবেন। যা আমাদের অতীত লব্ধ অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করবে। এছাড়াও আমাদের নিয়মিত প্রয়াস “নাটক রচনা শৈলী”কর্মশালাও যথাসময়ে আয়োজিত হবে। প্রতি তিনমাস অন্তর আমরা সাহিত্য আ্ডডার আয়োজন করবো। সেখানে দেশের বিখ্যাত সাহিত্যিক, কবি, চিত্রকর, সঙ্গীতজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, খেলোয়াড়, সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ, রাজনীতিক সহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনের সান্নিধ্য উপভোগ করবো। আমাদের দিগন্ত উন্মোচনের এই বৃহৎ সুযোগ সকলকে শানিত করবে বলে বিশ্বাস করি। অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা বের করার প্রস্তাবনা রয়েছে। রয়েছে ইউটিউব চ্যানেল প্রতিষ্ঠার বিষয়ও। রয়েছে নাট্যকার সংঘের সদস্যদের রচিত নাটক বিক্রির মাধ্যমে সংঘের তহবিল গঠন। আমরা সবকিছুর সম্ভাব্যতা যাচাই করে নাট্যকার সংঘকে একটি সর্বোচ্চ সৃজনশীল সংগঠনরূপে দেখবার প্রয়াসে নিয়োজিত থাকবো। সবশিল্পেরই উৎকর্ষতা এবং সময়ের সাথে পরিবর্তনের দাবী রাখে। নাট্যাকর সংঘও সেই দাবীর সাথে একমত। তাইতো নানান কর্মসূচী নিয়ে এই নতুন কার্যনির্বাহী পর্ষদ কাজ শুরু করে দিয়েছে। যথাসময়ে আপনাদের তা অবহিত করা হবে। আমরা চাই আপনারা একত্রিত হন। বন্ধুরা, আসুন আজকে এই আনন্দ সম্মিলনের মতো আমরা নিজেকে নিয়োজিত করি নিরন্তর চর্চার মধ্যে। তাহলেই কেবল উৎকর্ষতার শীর্ষে আমরা উপনীত হবো। আজকের এই নবযাত্রার সূচনালগ্নে আপানাদের প্রেরনা আমাদের উজ্জীবিত করবে সংঘকে এগিয়ে নিতে।
নাট্যকার সংঘের কার্যনির্বাহী কমিটির অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রায় শখানেক নাট্যকারের সঙ্গে এদিন সন্ধ্যায় আরো উপস্থিত ছিলেন নাট্যপরিচালক, শিল্পী, কলাকুশলী, সাংবাদিকসহ দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। তারা সবাই নাট্যকার সংঘের নতুন কার্যনির্বাহী কমিটিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এদিন সন্ধ্যায় গান-আড্ডায়-গল্পে ভরে উঠেছিল ঢাকাস্থ বনানী ক্লাবের বিশাল হল রুমটি। অনুষ্ঠান শেষে গান পরিবেশন করেন খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। রাজনীতি ও সমাজ সচেতনতামূলক গান শুনিয়ে তিনি দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন।